সোনাকান্দা জলকেল্লা


'সোনাকান্দা জলকেল্লা'

লেখা: মাহফুজা শিমু 

মানব সভ্যতা টিকিয়ে রাখার একটি অন্যতম শর্ত, নিরাপদ জীবন ব্যবস্থা। প্রকৃতির বিপরীতমুখী আচরণ কিংবা প্রতিপক্ষের আক্রমণ; নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যেই উৎপত্তি হয় দুর্গ ব্যবস্থার। প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা ছিলো এক সমৃদ্ধশালী অঞ্চল। যার দরুন বহিরাগতের আক্রমণ অতিষ্ঠ করে তুলেছিল এ অঞ্চলের মানুষকে। নদীমাতৃক হওয়ায় জলদস্যুদের অত্যাচার, লুটতরাজ প্রতিনিয়ত বিপর্যস্ত ও ভীতসন্ত্রস্ত করছিল বাংলার জনজীবন। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে বাংলায় যে দুর্গগুলো গড়ে তোলা হয়েছিল, তারমধ্যে অন্যতম একটি দুর্গ হচ্ছে সোনাকান্দা দুর্গ।


আমরা যদি এ দুর্গের ইতিহাসের দিকে তাকাই, তবে দেখতে পাই, সপ্তদশ শতাব্দীতে তৎকালীন মুঘল সুবেদার নদীপথে মগ ও পর্তুগিজ আক্রমণ এবং জলদস্যুদের লুন্ঠন থেকে ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাকে রক্ষার জন্য প্রকৌশলীদের সাথে পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেন তিনধাপে দুর্গ তৈরির। জলদস্যুদের নৌকা মেঘনা নদী দিয়ে আসবে ধলেশ্বরীতে, এরপর প্রবেশ করবে শীতলক্ষ্যায়। শীতলক্ষ্যা নদীতে নৌকা প্রবেশের পূর্বেই ধলেশ্বরীর মোহনায় কামানের গোলা ছোড়া হবে ইদ্রাকপুর দুর্গ থেকে যার অবস্থান ইছমতি-ধলেশ্বরী নদীর তীরে। এরপরও জলদস্যুদের নৌকা শীতলক্ষ্যায় প্রবেশে সক্ষম হলে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব তীর ও বুড়িগঙ্গা নদীর মিলনস্থলে, নবীগঞ্জ বন্দর এলাকায়‌ অবস্থিত সোনাকান্দা দূর্গ, এবং শেষ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম তীরে থাকবে হাজীগঞ্জ দুর্গ। এই পরিকল্পনারই বাস্তবায়িত রুপ হচ্ছে ত্রিভুজ জলদুর্গ বা ট্রায়াঙ্গল অব ওয়াটার ফোর্ট। এই ত্রিভুজ জলদুর্গের মধ্যে সোনাকান্দা দুর্গটি সবচেয়ে বড় এবং এর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও সুদৃঢ়।


দুর্গের নির্মাণকাল সংবলিত কোনো শিলালীপী পাওয়া না যাওয়ায় দূর্গটির প্রতিষ্ঠার সময়কাল এখনো অস্পষ্ট। নির্মাতা কে, সেটা নিয়েও রয়েছে মতপার্থক্য। অনুমান করা হয় এটি ১৬৫০ সালে নির্মিত। তবে লেখক মুন্সি রহমান আলী তার এক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন ১৬৬০-১৬৬৩ সালের মধ্যে দুর্গটি নির্মাণ করেন মুঘল সুবেদার মীর জুমলা। আবার, আহম্মাদ হাসান দানি তার ‘মুসলিম আর্কিটেকচার অব বেঙ্গল’ গ্রন্থে লিখেছেন, ইসলাম খাঁ (শেখ আলাউদ্দিন চিশতি) ঢাকায় রাজধানী স্থাপন করার পর ১৬১০ সালে এটি নির্মাণ করেন।


মুঘল স্থাপত্য রীতিতে তৈরি সোনাকান্দা দুর্গ ইট দ্বারা নির্মিত। চতুর্ভুজাকৃতির এ দূর্গের দৈর্ঘ্য ৮৬.৫৬ মিটার এবং প্রস্থ ৫৭ মিটার। দূ্র্গের প্রধান দুটি অংশের একটি হচ্ছে আত্মরক্ষা প্রাচীর। ১.০৬ মিটার পুরুত্ব বিশিষ্ট এ প্রাচীরের উচ্চতা ৩.০৫ মিটার, যদিও বর্তমানে তা অনেকখানি কমে গেছে। প্রাচীরে রয়েছে অসংখ্য প্রশস্ত-অপ্রশস্ত ছিদ্র, যার মাধ্যমে গুলি এবং কামানের গোলা নিক্ষেপ করা হতো‌। নিরেটভাবে তৈরি হয়েছে দেওয়ালের তলদেশ। দূর্গপ্রাচীর মারলন নকশা দ্বারা সজ্জিত এবং এর চূরায় বুরুজ রয়েছে। মারলনগুলোর গড় উচ্চতা ১ মিটার। দুর্গের একমাত্র প্রবেশ তোরণের অবস্থান উত্তর দিকে যা চওরায় ৫ মিটার। খিলানযুক্ত এ প্রবেশ তোরণ একটি আয়তাকার ফ্রেমে আবদ্ধ এবং উভয়দিকের পলেস্তরায় বিভিন্ন আকৃতির প্যানেল নকশা দ্বারা সজ্জিত। প্রবেশদ্বারের মূল খিলান চতুষ্কেন্দ্রিক এবং বুরুজ চারটি রয়েছে চার কোণায়। পার্শ্ববুরুজগুলোর মধ্যে পশ্চিম পার্শ্বের বুরুজ গুলো পূর্বপার্শ্বস্থ বুরুজ অপেক্ষা অধিক প্রশস্ত। পূর্ব বুরুজের ব্যাস ৪.২৬ মি. এবং পশ্চিম বুরুজের ব্যাস ৬.৮৫ মিটা‌র। এবং এ বুরুজগুলো অষ্টভুজাকার।


প্রধান অংশ দুটির মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দুর্গের পশ্চিম দিকে নির্মিত গোলাকার কামান স্থাপনা মঞ্চ। মঞ্চটির দু’টি বৃত্তাকার অংশ আছে, অভ্যন্তরীন অংশটির ব্যাস ১৫.৭০ মি. এবং বাইরের অংশটির ব্যাস ১৯.৩৫ মিটার। বেষ্টণীপ্রাচীর দ্বারা পরিবেষ্টিত এ মঞ্চের উচ্চতা ৯.০৬ মিটার। কামান প্ল্যাটফর্মের উঁচু মঞ্চে প্রেবেশের জন্য একটি সিঁড়ি এবং পাঁচ খাঁজবিশিষ্ট খিলানযুক্ত প্রবেশপথ রয়েছে। কামান প্ল্যাটফর্মে শক্তিশালী কামান নদীপথে আক্রমণকারীদের দিকে তাক করা থাকতো, যা ছিলো মুঘল জলদুর্গের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। এই কামান স্থাপনা মঞ্চ ব্যাতিত দুর্গে আর কোনো স্থায়ী ইমারতের সন্ধান পাওয়া যায়নি।


উল্লেখ্য যে, সোনাকান্দা দুর্গটি হাজীগঞ্জ এবং ইদ্রাকপুর দুর্গ থেকে শুধু বড়-ই নয়, বরং এ দুর্গের আরো দু’টি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, গুলি ও কামানের গোলা ছোড়ার জন্য বুরুজবিশিষ্ট আয়তকার ছিদ্রযুক্ত অংশ এবং কামান প্ল্যাটফর্মের খিলানযুক্ত প্রবেশপথ। বাকি দু’টি দুর্গে এরকম খিলানযুক্ত প্রবেশপথ নেই এবং দূর্গগুলির পার্শ্ববুরুজ সোনাকান্দা দুর্গের পার্শ্ববুরুজের চেয়ে ভিন্ন।


জনশ্রুতি রয়েছে, দুর্গটির গুপ্ত সুরঙ্গ দিয়ে সোনারগাঁও এবং ঢাকার লালবাগ কেল্লার সাথে সংযোগ ছিলো। এছাড়াও নামকরণ নিয়েও রয়েছে নানা কল্পকাহিনী। কথিত আছে, বিক্রমপুরের কেদার রায়ের কণ্যা স্বর্ণময়ী (সোনাবিবি) জলদস্যুদের দ্বারা অপহৃত হলে সোনারগাঁ-এর শাসক বারো ভূঁইয়াদের অধিপতি ইশা খাঁ তাকে উদ্ধার করে দুর্গে নিয়ে আসেন এবং তার বাবাকে অনুরোধ করেন তাকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু মুসলমানের ঘরে রাত কাটানোর অভিযোগে কেদার রায় তাকে ফিরিয়ে নিতে অপারগতা প্রকাশ করলে মর্মাহত স্বর্ণময়ী দুর্গে বসে কেঁদেছিলেন বলে দুর্গের নাম হয় সোনাকান্দা।


এছাড়াও বলা হয়ে থাকে, ইশা খাঁ কেদার রায়ের কণ্যা স্বর্ণময়ীকে জোরপূর্বক বিয়ে করে এ দুর্গে এনে রেখেছিলেন। এতে স্বর্ণময়ী দুর্গে বসে কাঁদায় দুর্গের নাম হয়েছে সোনাকান্দা। তবে এসব কথার কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ বলেন, কেল্লার সাথে স্বর্ণময়ীর কাহিনীর কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এর নির্মাণশৈলী দেখলে বোঝা যায় এটি মুঘল আমলের। আর ইশা খাঁর শাসনকাল ছিলো এটি নির্মাণের বেশ আগে।


১৯৫০ সালে সোনাকান্দা দুর্গ জাতীয় প্রত্নতত্ব বিভাগের আওতায় এনে সংস্কার করা হয়। প্রত্নতত্ব অধিদপ্তরের অধীনে বেশ কয়েকবার এর সংস্কার কার্য সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে দুর্গটি জনসাধারণের জন্য উন্মক্ত।


Comments

Popular posts from this blog

চাঁদপুরে জাতীয় দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকার প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী অনুষ্ঠিত।

বৃক্ষরোপণ অভিযান'২৩ উপলক্ষ্যে গাছের চারা রোপণ ও বিতরণ কর্মসূচি পালন করেসুরতরী সাহিত্যে সাংস্কৃতিক সংসদ, চট্টগ্রাম।