সংঘাতের মুখে ইসলাম


 সংঘাতের মুখে ইসলাম

মেহেদী হাছান 


সংঘাতের মুখে ইসলাম" বইটি মুহাম্মদ আসাদ রচিত "Islam at the Cross-Roads" এর বাংলা অনুবাদ। বইটির এরুপ নামকরণের কারণ একজন পাঠক বইটির ভূমিকার প্রথম লাইনে গভীরভাবে লক্ষ্য করলেই সেটা খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারবে। বর্তমানে মুসলিম উম্মাহ সহ গোটা মানবতা আজ গভীর সংকটের মধ্যে পতীত। এই সংকট বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে শুরু করে সামগ্রিক সংকট। "বর্তমান যুগের মতো এমন অশান্ত যুগের সম্মুখীন মানবজাতি আর কখনোই হয়নি।" প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন অসংখ্য সমস্যার তৈরী হচ্ছে, যার নতুন নতুন ও অভূতপূর্ব সমাধানের প্রয়োজন হচ্ছে। 


সেক্ষেত্রে এসকল মৌলিক সমস্যা ও পরিবর্তনশীল অবস্থার গভীরতা কতটুকু? ইসলামের সাংস্কৃতিক লক্ষ্যের সাথে এসব পরিবর্তন, ক্রমবিকাশ কতোটা খাপ খাচ্ছে? মুসলমানদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পতনের মূল কারণ কি? এরপর বর্তমান পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতি আমাদের মনোভাব কেমন হওয়া উচিত? বর্তমান সময়ে আমাদের করণীয় কি? 


মুহাম্মদ আসাদ "সংঘাতের মুখে ইসলাম" বইটিতে মূলত এই সকল প্রশ্নেকে সামনে রেখে এর জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।


বইটি ভূমিকা ও উপসংহার সহ ৬টি অধ্যায় নিয়ে রচিত। এক নজরে এই ৬টি  অধ্যায় হলো-

      

       ১.ইসলামের মুক্ত পন্থা

       ২.পশ্চিমের ভাবধারা

       ৩.ক্রুসেডের প্রতিচ্ছায়া

       ৪.শিক্ষা প্রসঙ্গে 

       ৫.পরানুকরণ প্রসঙ্গে 

       ৬.হাদিস ও সুন্নাহ

       ৭.সুন্নাহর প্রাণবস্তু 


◉ "পশ্চিমের ভাবধারা" অধ্যায়ে লেখক পশ্চিমা ও ইসলামী চিন্তাধারার মৌলিক ও তুলনামূলক পর্যালোচনা করেছেন। লেখক প্রমাণ করেছেন যে ইসলামী নৈতিকতা,ইসলামের সামাজিক ও ব্যক্তিগত বিষয়াদি, বিচার ও স্বাধীনতার ধারণা পাশ্চাত্য সভ্যতার ধারণা ও আদর্শ থেকে বহুগুনে পূর্ণতর । একইসাথে লেখক খ্রিষ্টীয় মনোভাবের সাথে পশ্চিমা মনোভাবের সম্পর্ক নিয়ে তুলানামূলক বিশ্লেষণ করেছেন এবং খ্রিস্টান ধর্মের অসারতা বা গীর্জার ভাবধারার সাথে ইউরোপীয় প্রতিভার মধ্যযুগীয় সংঘর্ষের কারণ তুলে ধরেছেন।


◉ ইসলামের মুক্ত পন্থা এই অধ্যায়ে লেখক ইসলামের নৈতিক ভিত্তি সম্পর্কে একটি মুটামুটি ধারণা দিয়েছেন। আমরা সহজেই উপলব্ধি করতে পারি যে ইসলামী সমাজ শুরু থেকেই গড়ে উঠেছিল ধর্মীয় বুনিয়াদের উপর। এখানে সর্বোপরি রয়েছে ধর্মীয় বিবেচনা এবং তা দ্বারাই সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে তাই আমাদের করণীয় হলো মানব জীবনে সর্বপ্রথম ধর্মের অবস্থান নির্ধারণের চেষ্টা করা। পাশাপাশি লেখক দেখিয়েছেন বৈজ্ঞানিক ও ধর্মীয় ধারণার মধ্যে কোন মৌলিক বিরোধ নেই। বরং উভয়ের মধ্যে ভারসাম্যমূলক সমন্বয় একমাত্র ইসলাম ধর্মের মধ্যেই সম্ভব। 


◉ "ক্রুসেডের প্রতিচ্ছায়া" এই অধ্যায়ে লেখক দেখিয়েছেন পাশ্চাত্য স্বভাবতই ধর্ম বিরুধী। যদিও অন্যান্য ধর্ম বা মতাদর্শের সাথে ভারসাম্যযুক্ত চিন্তামূলক মনোভাব বজায় রাখে কিন্তু ইসলামের প্রতি তাদের বিদ্বেষ সবচেয়ে বেশি। তাদের এই বিদ্বেষের উন্মেষ ঘটেছিল মূলত ইউরোপের নবচেতনা লাভের পরবর্তী ইসলামের সাথে সংঘটিত ক্রুসেডের মাধ্যমে। একইসাথে উক্ত অধ্যায়ে লেখক যৌক্তিকভাবে প্রমাণ করেছেন যে কেন ইসলাম ও পশ্চিমা সভ্যতার মধ্যকার পাশাপাশি বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক সম্ভব নয় এবং ইসলামের প্রতি তাদের গোড়ামি প্রসূত মূল মনোভাবের কারণ তুলে ধরেছেন।


◉ "শিক্ষা প্রসঙ্গে" এ অধ্যায়ে লেখক বলেন পশ্চিমা ভাবধারা মৌলিক দিক দিয়ে ধর্মবিরোধী। সেক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে এর শিক্ষা পদ্ধতিও অনুরুপ হতে বাধ্য। পাশ্চাত্য যেহেতু জন্মগতভাবেই ইসলামী বিদ্বেষী সেক্ষেত্রে ইউরোপীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত কোন ব্যক্তি  ইসলাম বিরোধী প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারবে না। কেননা এই শিক্ষাব্যবস্থার সর্বপ্রথম শিক্ষাই হচ্ছে ধর্ম বিমুখ হওয়ার উৎসাহ প্রদান। তাই এই শিক্ষাব্যবস্থার অধীনে বেড়ে উঠা ধর্মবিমুখ মনোভাব সৃষ্টি হওয়ার জন্য যথেষ্ট। এরকম শিক্ষা ব্যবস্থার ফলাফল হলো একজন মুসলিম তরুণের মনে তার নিজস্ব তমুদ্দুন, ঐতিহ্য ও ভবিষৎ সম্ভাবনা সম্পর্কে হীনমন্যতার সৃষ্টি হবে । 


◉ "পরানুকরণ" এই অধ্যায়ে লেখক  মুসলিম উম্মাহ কর্তৃক পশ্চিমাদের অনুকরণ করার প্রবণতা প্রথম যে সময় থেকে এই রোগের উৎপত্তি  শুরু হয় সেই উৎপত্তিস্থল, এর কারণ ও পরবর্তী প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং এই সমস্যা থেকে মুক্তির উপায় ও বাতলে দিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন, পশ্চিমাদের অনুকরণে ইসলামের উন্নতির ছদ্মনামে কিভাবে ইসলামী সমাজনীতিকে অস্বীকার করার পথ রচিত হয়। এখানে লেখক শুধু পশ্চিমাদের অনুকরণের সমালোচনাই করেননি। বরং বাস্তবিকভাবে আমাদের করণীয় কি সেটিও বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেনঃ "মুসলমান ব্যক্তিবিশেষ তার নিজস্ব সভ্যতাকে বিনষ্ট না করে বিদেশী সভ্যতার নতুন সুনির্দিষ্ট প্রভাব সব সময়েই গ্রহণ করতে পারে।"


◉ হাদিস ও সুন্নাহ অধ্যায়ে লেখক জোড়ালোভাবে প্রমাণ করেছেন যে সুন্নাহ ইসলামের অস্তিত্ব ও অগ্রগতির সমার্থক এবং সুন্নাহর প্রতি উপেক্ষাও ইসলামের বিনাশ ও ধ্বংসের সমার্থক। সুন্নাহ শুধু অতীত আরবদের জন্যই ছিল বর্তমান সময়ের রুচিবান ভদ্রলোকদের জন্য নয় এই বিচিত্র মনোভাবসহ, হাদিসের নির্ভরযোগ্যতা ও সুন্নাহর পূর্ণাঙ্গ কাঠামো অস্বীকার করা এই সকল মনোভাব সমূহের কারণ বিশ্লেষণ করেছেন। বিশেষভাবে এরকম মনোভাবের কারণ হিসেবে লেখক নবুয়তের প্রতি উপযুক্ত মর্যাদা  ও তাৎপর্য উপলব্ধি করতে না পারাকে দায়ী করেছেন। 


◉ সুন্নাহর প্রাণবস্তু অধ্যায়ে লেখক কুরআন কারিমের সাথে সর্বকালের জন্য হযরত রাসূল সাঃ এর প্রেরণাদায়ক ও পথনির্দেশকারী ব্যক্তিত্বের সংযোগের কারণ বিশ্লেষণ করেছেন এবং সুন্নাহর গভীর তাৎপর্য তুলে ধরেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেনঃ "আমাদের চুক্তি অনুযায়ী যার মারফতে কুরআন কারীমের শিক্ষা মানবজাতির কাছে নাজিল হয়েছে, তার চেয়ে সে শিক্ষার আর কোন শ্রেষ্ঠ বিশ্লেষণকারী হতেই পারে না। "


◉ বইটির বিশেষত্বঃ  মুহাম্মদ আসাদ একজন নব দিক্ষিত মুসলিম ছিলেন এবং তার জন্ম হয়েছিল অস্ট্রিয়ার এক ইহুদি পরিবারে। এই বইটির সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব এখানেই যে, লেখক নিজে পশ্চিমাদের খুব ভালোভাবে, খুব কাছ থেকে জানার দরুণ এই সভ্যতার অভ্যন্তরীণ ভিত্তিমূল সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে খন্ডিয়েছেন এবং ইসলামে শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেছেন। ফলশ্রুতিতে একজন পাঠককে যখন এই বইটি পড়বে তখন সে কাল্পনিক টাইম মেশিনের মতো পশ্চিমী ভাবধারার বুদ্ধিবৃত্তিক গঠনের শৈশব কাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ঘুরে আসতে পারবে।

Comments

Popular posts from this blog

চাঁদপুরে জাতীয় দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকার প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী অনুষ্ঠিত।

বৃক্ষরোপণ অভিযান'২৩ উপলক্ষ্যে গাছের চারা রোপণ ও বিতরণ কর্মসূচি পালন করেসুরতরী সাহিত্যে সাংস্কৃতিক সংসদ, চট্টগ্রাম।

সোনাকান্দা জলকেল্লা