রমজান হোক পুনর্জাগরণের মাস


 “রমজান হোক পুনর্জাগরণের মাস”

-------------------------------------------

হাসাল আল ফিরদৌস 

প্রচন্ড খরা শেষে বৃষ্টির আহ্বান নিয়ে ছুটে আসা শীতল বাতাস যেমন, রমজানের আহ্বানও যেন ঠিক তেমন। অথবা রুক্ষ মাটিতে বৃষ্টির অবাধ্য ফোঁটার ছোঁয়ায় সৃষ্টি হওয়া সোঁদা ঘ্রাণের মতো। রমজান এমন এক আধ্যাত্মিক সময়কাল, যে সময়ে গোটা মুসলিম উম্মাহর অন্তরে রুহানি বাতাস বইতে থাকে। সেহরি-ইফতারের আমেজ, তারাবিহ, ইফতারির ঘ্রাণ, রহমত-বরকত-মাগফিরাতের সওগাত, সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির নতুন খুশবু মিলেমিশে জান্নাতি এক অনুভূতি প্রবাহিত হতে থাকে প্রতিটি মুসলিমের অন্তরে, যা শুধুই অনুভবের। আর এ অনুভূতির দাবিতেই কেবল সকল বাহ্যিকতার ঊর্ধ্বে গিয়ে প্রতিটি রুহানি অন্তর পারে আরেকটি অন্তরের কাছে ‘পুনর্জাগরণ’ এর অনুভূতিকে পৌঁছে দিতে। সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার পূর্বপুরুষগণ আমাদের সে শিক্ষাই দিয়ে গেছেন। আমরা যদি সে শিক্ষার ইতিহাসকে পর্যালোচনা করি, তবে সুস্পষ্ট দেখতে পাই–


• রমজান ‘انشاء الأخلاق’ এর মাসঃ


মুসলিম উম্মাহর পতনের অন্যতম প্রধান কারণ ‘আখলাকী পতন’। রাষ্ট্রীয় আখলাক থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত আখলাক পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রেই এ সংকট ফুটে উঠেছে প্রবলভাবে। রমজান বিশ্বজনীন এ সংকট মোকাবেলার শিক্ষাই দিয়ে যায় আমাদের।


• রমজান আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তৈরির মাসঃ


সম্পর্কের অন্যতম ভিত্তি জ্ঞান ও বাণিজ্য। বিশ্ব অর্থনীতির সংকটকালে মুসলিম উম্মাহর এ কথা বিশেষভাবে স্মরণ করা উচিত। কেননা এ রমজানেই আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন কোরআন নাযিল করে আমাদের সাবধান করেছিলেন,


ﻭَﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻛَﻔَﺮُﻭﺍ ﺑَﻌْﻀُﻬُﻢْ ﺃَﻭْﻟِﻴَﺎﺀُ ﺑَﻌْﺾٍ ۚ ﺇِﻟَّﺎ ﺗَﻔْﻌَﻠُﻮﻩُ ﺗَﻜُﻦ ﻓِﺘْﻨَﺔٌ ﻓِﻲ ﺍﻟْﺄَﺭْﺽِ ﻭَﻓَﺴَﺎﺩٌ ﻛَﺒِﻴﺮ

যারা সত্য অস্বীকার করেছে, তারা পরস্পরকে সাহায্য-সহযোগিতা করে৷ যদি তোমরা এটা না করো, তাহলে পৃথিবীতে ফিতনা সৃষ্টি হবে ও বড় বিপর্যয় দেখা দেবে৷ (সূরা আনফাল: ৭৩)

এ আয়াত স্পষ্টই দিকনির্দেশনা দিচ্ছে কোন কোন ব্যাপারে আমাদের পারস্পারিক সাহায্য করা আবশ্যক। সেগুলো হলোঃ


১) জ্ঞানের ক্ষেত্রে সহযোগিতা

২) অর্থনৈতিক সহযোগিতা


অথচ আজ মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ দুটি বিষয়েই প্রচণ্ড রকম ঘাটতি! তাই রমজানকে কেন্দ্র করে সকল বিভেদ ভুলে গড়ে উঠতে পারে ‘ইসলামিক ইউনিয়ন’ বাস্তবায়নের নতুন দুয়ার। রমজানে সকল হৃদয়ে আধ্যাত্মিক ছোঁয়া ও রুহানি পরশের সম্মিলনে সে সম্পর্ক সৃষ্টির আবেশ থাকে; শুধু প্রয়োজন আমাদের প্রচেষ্টার।


• রমজান আকলের সত্যিকার ব্যবহার ও গুরুত্বারোপের মাসঃ


ওহী এবং আকলের সমন্বয় ঘটিয়ে ইমাম মাতুরিদীর মতো আলেম, ইমাম গাজ্জালীর মতো মুতাকাল্লিম, মিমার সিনানের মতো বিজ্ঞানী গড়ে তোলার উদ্যোগ ও শপথ নেওয়ার মাস এ রমজান।


• রমজান ক্বলবকে পরিচ্ছন্ন করার ও তাকওয়া অর্জনের মাসঃ


মহান প্রভুর সাথে একান্ত আলাপন, জিকির, তিলাওয়াত, নফল ইবাদতের মধ্য দিয়ে ক্বলব পরিছন্ন করার উৎকৃষ্ঠ সময় রমজান। তাকওয়ার কথা বলতে গিয়ে আল্লাহ বলেন,


ﻭَﻟَﻮْ ﺃَﻥَّ ﺃَﻫْﻞَ ﺍﻟْﻘُﺮَﻯ ﺁﻣَﻨُﻮﺍْ ﻭَﺍﺗَّﻘَﻮﺍْ ﻟَﻔَﺘَﺤْﻨَﺎ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻢ

ﺑَﺮَﻛَﺎﺕٍ ﻣِّﻦَ ﺍﻟﺴَّﻤَﺎﺀ ﻭَﺍﻷَﺭْﺽِ


আর যদি জনপদের অধিবাসীরা ঈমান

আনে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে, তাহলে

আমি তাদের প্রতি আসমান ও জমিনের সমস্ত বরকতসমূহের দরজা খুলে দিবো। (সূরা আরাফ: ৯৬)


• রমজান জিহাদ ও যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তোলার মাসঃ


জুলুম উৎখাতের আন্দোলন, আদালত প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এবং দ্বীনের জন্য না খেয়ে থেকে জীবন দান করার ‘বদর যুদ্ধ’ এ মাসেই হয়েছে। ইখতিয়ার উদ্দিনের বঙ্গবিজয়ও এ মাসেই। তাই রমজানকে কেন্দ্র করে সকল যুবকের চিন্তারাজ্যে উপলব্ধি হওয়া উচিৎ যে, প্রতিটি যুদ্ধ-সংগ্রামই হক্ব প্রতিষ্ঠার, জুলুমের প্রতিবাদে আন্দোলনের নাম। আর সকল আন্দোলন, মুক্তির জন্য প্রধান শর্ত যোগ্য নেতৃত্ব। ইসলামী সভ্যতার পতনের কারণ ও বর্তমান মুসলিমদের সবচেয়ে বড় সংকটও এ যোগ্য নেতৃত্ব! সুতরাং রমজান থেকেই হাজারো সুলতান ফাতিহ, জহির উদ্দিন বাবর গড়ে তোলার প্রতিজ্ঞা গ্রহন করতে হবে।


• রমজান আল-কোরআন নাযিলের মাসঃ


ﺷَﻬْﺮُ ﺭَﻣَﻀَﺎﻥَ ﺍﻟَّﺬِﻱَ ﺃُﻧﺰِﻝَ ﻓِﻴﻪِ ﺍﻟْﻘُﺮْﺁﻥُ ﻫُﺪًﻯ ﻟِّﻠﻨَّﺎﺱِ

ﻭَﺑَﻴِّﻨَﺎﺕٍ ﻣِّﻦَ ﺍﻟْﻬُﺪَﻯ ﻭَﺍﻟْﻔُﺮْﻗَﺎﻥِ ﻓَﻤَﻦ ﺷَﻬِﺪَ ﻣِﻨﻜُﻢُ ﺍﻟﺸَّﻬْﺮَ

ﻓَﻠْﻴَﺼُﻤْﻪ


রমজান মাস হলো সে মাস, যে মাসে মানবজাতির পথপ্রদর্শক, পথ প্রদর্শনের উজ্জল নিদর্শনসমূহ এবং ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্যকারী কোরআন নাযিল করা হয়েছে। অতএব যে এ মাস পেল, সে যেন অবশ্যই রোজা রাখে। (সূরা বাকারা: ১৮৫)


তাই কোরআনকে কেন্দ্র করেই আমরা আবার ঐক্যবদ্ধ হবো, মানবতার মুক্তির সংগ্রাম চালিয়ে যাবো।


• রমজান জ্ঞানের পুনর্জাগরণের মাসঃ


احياء العلوم , تجديد الفكر , الإصلاح في المنهج

জ্ঞানের পুনর্জাগরণ, চিন্তার আধুনিকায়ন, পন্থার সংশোধন– এ তিনটি ছাড়া নতুন সভ্যতা বিনির্মাণ অসম্ভব। তাই রমজান প্রত্যেকটি বিষয়কে আলাদা আলাদা ভাবে গড়ে তোলার শিক্ষা দেয়। যেমন- রমজান আমাদের আধ্যাত্মিক শক্তি দিচ্ছে, কিন্তু জ্ঞানের মৃত্যুবরণের কারণে সেটিও আমরা উপলব্ধি করতে পারছি না! সুতরাং ভয়াবহ এ ঘাটতিগুলো পূরণের সুস্পষ্ট হিকমাহ-ই তুলে ধরছে রমজান। প্রফেসর ডঃ মেহমেদ গরমেজের ভাষায় ‘ইসলামী সভ্যতার বিজয়ের প্রধান শর্ত জ্ঞানের পুনর্জাগরণ’।


• রমজান সামাজিক সৌহার্দ্যের মাসঃ


ইসলামী সভ্যতা রমজানকে কেন্দ্র করে যুব-বান্ধব কর্মসূচি গ্রহণ করতো, উৎসবের আয়োজন করতো, যা গোটা সমাজের সকলকেই একত্রিত করে একটি রুহানি প্লাটফর্ম দিতো এবং সাথে থাকতো ইসলামের প্রাণসত্তা, সুদূরপ্রসারী চিন্তা, উম্মাহ কেন্দ্রিক চেতনা। রমজানকে কেন্দ্র করে যে পরিবেশ সৃষ্টি হতো, রাষ্ট্রীয় উদ্দীপনা শুরু হতো, তাতে সবাই স্বজন হারানো গরীবদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর শিক্ষা পেতো, নিজে গোপনে উপকার করা ও অন্যান্য যুবক, শিশুদের উৎসাহ প্রদান করা, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আনন্দ বঞ্চিত সব বন্ধুদের জন্য দোয়া করা, মুজাহিদদের জন্য দোয়া করা, সামর্থ্য অনুযায়ী সাদকা করার শিক্ষা পেতো ও তা বাস্তবায়ন করতো। প্রতিবেশী, গরীবদের পাশে থাকা তো মুসলমানদের ঈমানের অংশ হিসেবেই গণ্য হতো। পাঞ্জাবী, জুব্বা, লুঙ্গি পরে সবাই মিলে তারবীহ পড়তে যাওয়া; নকশি টুপি পরা, গায়ে আতর মাখা, বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী খাবার রান্না করে সবাইকে নিয়ে ইফতার করা আর এ উৎসবমুখরতায় অন্যান্য ধর্মের সকলকে নিয়েই একাকার হয়ে যেত মুসলিম উম্মাহ।

রমজান এ শিক্ষা নিয়ে আবারও হাজির হয়েছে।


• রমজান পারস্পরিক সম্পর্ক ও শিশু-কিশোরদের উজ্জীবিত করার মাসঃ


চারদিক ইফতারের ঘ্রাণ, সবাইকে দাওয়াত দেওয়া, দাওয়াত খাওয়ার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠে অন্য রকম সম্প্রীতি। আর তাকে কেন্দ্র করে নানা ক্যালিগ্রাফি, আর্ট, শিল্পচর্চা দিয়ে ভরে উঠুক প্রতিটি রাস্তা, বাড়ির দেয়াল। বাচ্চাদেরকে নিয়ে এসব সাজানো, নানাবিধ গান, তাকবীর, জিকিরে ভরে উঠুক চারপাশ।রমজান বিশ্ববাসীর মুক্তির সংস্কৃতি, সামাজিক আন্দোলনের নাম। রমজান এক বিশ্বজনীন উৎসবের নাম। রমজান আধ্যাত্মিক বলয় সৃষ্টিকারী প্রশান্তির নাম। রমজান গোটা উম্মাহকে রুহানি বন্ধনে আবদ্ধকারী মহান অনুভূতির নাম। রমজান বিশ্ব মানবতার মুক্তির শপথ নেওয়ার নাম।


হৃদ মাঝারে আজ এক রুহানি বাতাস বইতে শুরু করেছে, সে শীতল বাতাসের উপলব্ধি থেকে প্রখ্যাত কবি সেজাই কারাকোচের ভাষায় বলতে চাই, “মুসলিম উম্মাহ যদি এখনও জীবিত থাকে, মূলত রমজানের কারণেই জীবিত আছে। আর একদিন যদি পরিপূর্ণভাবে জেগে ওঠে, তাহলে রমজানের মাধ্যমে জেগে উঠবে। আর সে জাগরণ শুরুও হবে রমজানের মাধ্যমেই।”


“আহলান, সাহলান, মাহে রমজান!”

Comments

Popular posts from this blog

চাঁদপুরে জাতীয় দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকার প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী অনুষ্ঠিত।

বৃক্ষরোপণ অভিযান'২৩ উপলক্ষ্যে গাছের চারা রোপণ ও বিতরণ কর্মসূচি পালন করেসুরতরী সাহিত্যে সাংস্কৃতিক সংসদ, চট্টগ্রাম।

সোনাকান্দা জলকেল্লা